আম আঁটির ভেঁপু

নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো…

ভারতে ব্রিটিশ শাসন (তৃতীয় পর্ব)

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
ব্রিটিশ রাজের শাসন (১৮৫৮-১৯৪৭)
লর্ড ক্যানিং

লর্ড কানিং (Lord Canning) (১৮৫৬-৬২)

ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়ে লর্ড ডালহৌসি ১৮৫৬ সালে স্বদেশে ফিরে যান এবং লর্ড ক্যানিং তাঁর স্থলে বড় লাট হিসেবে নিযুক্তি পান। ১৮৫৭ সালে সমগ্র ভারতবর্ষে অভূতপূর্ব সিপাহী বিদ্রোহ (Sepoy Rebellion/ Sepoy Mutiny ) শুরু হয় ইতিহাসে যা ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে প্রথম ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা আন্দোলন নামে অভিহিত হয়। সিপাহী বিদ্রোহ একটি বিক্ষুব্ধ প্রতিরোধ প্রয়াস হলেও তা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সিপাহী ও রাজন্যবর্গের মধ্যে সীমিত ছিল। যুদ্ধ ভারতবর্ষের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়লেও স্থানভেদে যুদ্ধের প্রকৃতি, বিস্তৃতি ও জনগনের ভুমিকা ভিন্ন ছিল। যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ হিসেবে এনফিল্ড রাইফেলের টোটায় ‘গরু ও শূকরের চর্বি মিশ্রণের’ কাহিনী মুখ্য ভূমিকা রাখলেও এর সুনির্দিষ্ট রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক, ধর্মীয় ও সামরিক কারণ ছিল।

তাঁতিয়া তোপীর নেতৃত্বাধীন বিদ্রোহী সিপাহী দল

সিপাহী বিদ্রোহ ব্যারাকপুর থেকে মীরাট (১০ মে, ১৮৫৮) এবং সেখান থেকে দিল্লিতে (১১ মে, ১৮৫৮) বিস্তার লাভ করে। বিদ্রোহী সিপাহীরা ১১ মে দিল্লীর লালকেল্লা দখল করে দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরকে হিন্দুস্তানের সম্রাট বলে ঘোষণা করে। মীরাট ও দিল্লিতে সিপাহীরা ব্রিটিশ অফিসারদের হত্যা করে। ক্রমে এ বিদ্রোহ দ্রূত গতিতে ফিরোজপুর, মুজাফফরনগর, পাঞ্জাব, নৌসেরা, হতমর্দান, অযোধ্যা, মথুরা, রুরকী, লক্ষ্ণৌ, বেরিলী, শাহজাহানপুর, মোরাদাবাদ, আজমপুর, কানপুর, এলাহাবাদ, ফৈজাবাদ, ফতেহপুর, ফতেহগড় ও অন্যান্য বহু স্থানে ছড়িয়ে পড়ে। একক কোনো নেতৃত্বে এই বিদ্রোহ পরিচালিত না হলেও, কানপুরের নানা সাহেব, তাঁতিয়া তোপী, মঙ্গল পাণ্ডে, আজিমউল্লাহ, ভগত সিং ও ঝাঁসির রানী লক্ষ্ণী বাঈ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ঝাঁসির রানী লক্ষ্ণী বাঈ

১৮৫৭ সালী ২১ সেপ্টেম্বর ইংরেজ বাহিনী দিল্লী দখল করে সম্রাটকে সপরিবারে বন্দি করে এবং তাঁর দুই পুত্র ও এক পৌত্রকে বিনা বিচারে হত্যা করে।১৮৫৮ সালের জানুয়ারি মাসে বৃদ্ধ সম্রাটকে রেঙ্গুনে নির্বাসিত করা হয় এবং সেখানেই ১৮৬২ সালে তাঁর মৃত্যু হয়। ইংরেজরা এই অভূতপূর্ব বিদ্রোহকে নৃশংস, বর্বর ও নির্দয়ভাবে দমন করে। দেশীয় সৈন্যদের কোনো একক নেতৃত্ব না থাকা, ব্রিটিশ বাহিনির দক্ষ ও চৌকসভাবে যুদ্ধ পরিচালনা, স্থানীয় জমিদারদের ব্রিটিশসাম্রাজ্যের পক্ষ অবলম্বন, শিখ ও নেপালি সৈন্যদের সমর্থন দান প্রভৃতিকে মূলত এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হবার কারণ বলে মনে করা হয়।

দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফর

সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহ জাফরের দুই পুত্র

বিদ্রোহ দমন হওয়ার পর, মহারাণী ভিক্টোরিয়া ১ নভেম্বর, ১৮৫৮ সালে এক ঘোষণা বলে ভারত শাসন বিধি ১৮৫৮ (India Act of 1858)  জারি করেন। এর ফলে ভারতবর্ষে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির শাসন অবসান ঘটে এবং ব্রিটিশ রাজের প্রত্যক্ষ শাসন শুরু হয়। লর্ড ক্যানিংকে ভারতের প্রথম ভাইসরয় ঘোষণা করা হয় এবং ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার একজন সদস্যকে ভারত সচিব করা হয়।

ক্যানিং ১৮৫৯ সালে লর্ড ডালহৌসি কর্তৃক প্রণিত স্বত্ব-বিলোপ নীতি (Doctrine of Lapse) বিলুপ্ত করেন। তিনি ১৮৫৮ সালে ভারতীয় ফৌজদারি বিধি (Indian Penal Code 1858) ও ১৮৫৯ সালে Code of Criminal Procedure (CrPC 1859) প্রণয়ন করেন। ১৮৬১ সালে তিনি Indian Council Act, 1861 ও Indian High Courts Act, 1861 প্রণয়ন করেন। তাঁর শাসন আমলে ১৮৫৯-৬০ সালে বাংলায় নীল বিদ্রোহ দেখা দেয়।

বাংলায় স্থাপিত একটি নীল কারখানা

লর্ড এলগিন

লর্ড এলগিন (Lord Elgin) (১৮৬২-৬৩)

১৮৬২ সালে ভারতের প্রথম ভাইসরয় লর্ড ক্যানিং অবসর গ্রহণ করে দেশে ফিরে গেলে, লর্ড এলগিন ভাইসরয় হয়ে ভারতে আসেন। মাত্র এক বছরের মাথায়, ১৯৬৩ সালে পাঞ্জাবের ধরমশালায় এক পাহাড়ি  সেতু পার হওয়ার সময় তিনি হৃদযন্ত্রে কৃয়া বন্ধ হয়ে মারা যান। নতুন ভাইসরয় নিয়োগের পূর্ব পর্যন্ত ফিল্ড মার্শাল লর্ড নেপিয়ার (Field Marshal The Lord Napier of Magdala) ভারপ্রাপ্ত ভাইসরয়ের দায়িত্ব পালন করেন।

ফিল্ড মার্শাল লর্ড নেপিয়ার

লর্ড জন লরেন্স

লর্ড জন লরেন্স (Lord John Lawrence) (১৮৬৪-৬৯)

১৮৬৪ সালে লর্ড লরেন্স ভারতের ভাইসরয় নিযুক্ত হন। তিনি ১৯৬৮ সালে পাঞ্জাব প্রজাস্বত্ব আইন ও অযোধ্যা প্রজাস্বত্ব আইন পাস করেন। লরেন্স আফগানিস্তান ও পারস্য উপসাগরে ব্যাপারে ‘না হস্তক্ষেপ’ নীতি গ্রহন করেন। তিনি ভুটানরাজকে ভুয়ার্স অঞ্চল ছেড়ে দিতে বাধ্য করেন।  তার সময়ে উড়িষ্যায় এক মারাত্নক দুর্ভিক্ষের (১৮৬৫-৬৬) ফলে প্রায় দশ লক্ষ লোক মারা যায়। তিনি ভারতীয়দের শিক্ষাগ্রহণের সুযোগ বৃদ্ধি করেন, একই সাথে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে তাঁদের অংশগ্রহণের সুযোগ সংকুচিত করেন। ১৮৬৯ সালে তিনি ইংল্যান্ডে ফিরে আসেন।

লর্ড মেয়ো

লর্ড মেয়ো (Lord Mayo) (১৮৬৯-৭২)

লর্ড মেয়ো তার শাসনকালে (১৮৬৯-৭২) ভারতীয় প্রজাদের করভারে জর্জরিত করে এবং ব্যয়সঙ্কোচ নীতি গ্রহন করে রাজস্ব বৃদ্ধি করেন। তিনি আজমীরে মেয়ো কলেজ এবং লাহোর ও রাজকোটে কলেজ স্থাপন করেন। মেয়ো স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার উন্নতির জন্য ১৮৭০ সালে এক আইন দ্বারা শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রভৃতি বিষয়ের দায়িত্ব স্থানীয় সংস্থাগুলোর হাতে প্রদানের ব্যবস্থা করেন। ১৮৭২ সালে লর্ড মেয়ো আন্দামানে দ্বীপান্তরদণ্ডে দণ্ডিত ব্যক্তিদের বাসস্থান পরিদর্শনকালে জনৈক পাঠান কয়েদির আকষ্মিক ছুরিকাঘাতে মৃত্যুবরণ করেন।

লর্ড নর্থব্রুক

লর্ড নর্থব্রুক (Lord Northbrook) (১৮৭২-৭৬)

আততায়ীর হাতে লর্ড মেয়ো প্রাণ হারালে লর্ড নর্থব্রুক ভারতের ভাইসরয় নিযুক্ত হন। তার শাসনকালে বিহারে বড় ধরণের দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। তিনি ছিলেন অবাধ বাণিজ্যনীতি গ্রহণের অনুসারী। নর্থব্রুক লাইসেন্স কর, মাদ্রাজে গৃহকর, বোম্বাইয়ের অ-কৃষি কর এবং মধ্য প্রদেশের পাণ্ডারি কর লোপ করেন। বৃটিশ মন্ত্রিসভা, বিশেষকরে তৎকালীন ভারত সচিব জর্জ ক্যাম্পবেল, ডিউক অব আরগিলের (George John Douglas Campbell, 8th Duke of Argyll) সাথে মতানৈক্যের কারনে ১৮৭৬ সালে ভাইসরয়ের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।

চতুর্থ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন

5 comments on “ভারতে ব্রিটিশ শাসন (তৃতীয় পর্ব)

  1. নিবিড়
    জুলাই 20, 2010

    আপনার ব্লগটা আজকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখছিলাম। আপনার সাথে একটা বিষয়ে সম্ভবত আমার মিল আছে। ব্লগ দেখে মনে হল আপনিও আমার মত ইতিহাস নামক বস্তুটিকে ভাল পান 🙂

    Like

    • অনেক কৃতজ্ঞতা রাশেদ ভাই। হ্যা আপনি ঠিক ধরেছেন, ছোট বেলা থেকেই ইতিহাস আর আন্তর্জাতিক রাজনীতি আমার খুব পছন্দের বিষয় 🙂
      হঠাৎ করে ব্যস্ততা বেড়ে যাওয়ায় পোস্টটি শেষ করতে পারি নি, এখন লজ্জাই লাগছে। ভালো থাকুন। শুভেচ্ছা।

      Like

  2. তাপস
    অগাষ্ট 23, 2010

    তোমার ব্লগ পড়ে একটু ইতিহাস চর্চা হলো। নানা সাহেব, তাঁতিয়া তোপী, মঙ্গল পাণ্ডে, আজিমউল্লাহ, ভগত সিং ও ঝাঁসির রানী লক্ষ্ণী বাঈ এই যে নাম গুলো দিয়েছ তারা বৃটিশের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করলেও সবটাই সেই সময় স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল না। ধন্যবাদ ভাই চালিয়ে যাও। তাও একটু ইতিহাস চর্চা হবে তোমার কল্যানে।

    Like

    • শেখ আমিনুল ইসলাম
      অগাষ্ট 24, 2010

      অনেক কৃতজ্ঞতা তাপসদা। পোস্টগুলো এখনো অসম্পূর্ণ। সময় পেলেই সংশোধন ও আপডেট করে যাচ্ছি।
      আপনার মন্তব্য পেয়ে অনেক অনুপ্রাণিত হলাম 🙂

      Like

  3. Saifur Rahman Saif
    অগাষ্ট 30, 2020

    খুব ভালো লাগলো ভাইয়া।খুব সাজিয়ে লেখা এবং কোনটার পর কোনটা বুঝতে খুব হেল্পফুল হয়েছে।ধন্যবাদ

    Like

আপনার মন্তব্য লিখুন

Information

This entry was posted on জুন 14, 2010 by in ইতিহাস and tagged .

নেভিগেশন