আম আঁটির ভেঁপু

নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো…

শ্রাবণের দ্বিতীয় দিবস

দুপুর থেকেই ঝুম বৃষ্টি পড়ছে। থামার কোনো লক্ষণ নেই। থেকে থেকে বৃষ্টির তেজ যেন বাড়ছে। অবশ্য সকাল থেকেই আকাশ মেঘে ঢাকা পড়েছিল। বৃষ্টি হবে হবে করে পরিবেশটাকে গুমোট করে তুলেছিল, সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল ভ্যাঁপসা গরম। সকালে ঘুম থেকে ওঠে হটাৎকরেই নিজের মাঝে একটা বিষন্নতাবোধ আবিষ্কার করে শফিকুল। কেন এমন লাগছে, নিজেকে দুঃখপ্রিয় মনে হচ্ছে; মনের মাঝে হাতড়ে ফিরেও কারন খুঁজে পায় না সে। বড় বিচিত্র মানুষের মন! শ্রাবণের আকাশের মতই, এই ভালো এই খারাপ। অকারন মন খারাপের বয়সটা বিশ্ববিদ্যালয়ের সোনালী দিনগুলোতেই রেখে এসেছে সে। শৃঙ্খলিত পার্থিব এক জীবনে লাগামহীনভাবে এখন শুধু ছুটে চলা। কোনো গন্তব্য নেই, দুঃখ নেই, আনন্দ নেই, ক্লান্তি নেই। শুধু ছুটে চলা। বৃত্তবন্দী হয়ে প্রতিদিনের মত একই পথে নিরন্তর ছুটে চলা।

ঘন্টাখানেক আগে অফিস ছুটি হয়েছে, তবুও অসহায়ের মত বসে থাকা ছাড়া কিছুই করার নেই শফিকুলের। বারোমাস ঠান্ডার সমস্যা লেগেই আছে। শেষ রাতে নতুন করে যোগ হয়েছে শুকনো কাশি। ডাক্তার দেখাতে ইচ্ছে করে না। কেন ডাক্তার দেখাবে, কেউ তো বলে না শফিকুল তোমার শরীর ঠিকঠাক চলছে না, তুমি বড় ক্লান্ত! শুকনো কাশিটা বুকে বসে গেছে, নিজেকে একটু বুঝতে চেষ্টা কর, ভালো একটা ডাক্তার দেখাও। নাহ! কেউ নেই বলার। চারিদিকে এত এত মানুষ। এত এত কোলাহল। তার মাঝেও শফিকুল বড় একা, ভিষন একা! বৃত্তবন্দী হয়ে প্রতিদিনের মত একই পথে নিরন্তর ছুটে চলা। কোনো গন্তব্য নেই, দুঃখ নেই, আনন্দ নেই, ক্লান্তি নেই। শুধু ছুটে চলা।

মা-বাবা দুজনই বড় ভাই রফিকুলের সাথে কুষ্টিয়ায় থাকে। মা মাস তিনেক পরে একদিন এসে দেখে যায় ছেলেটাকে। ছোট ছেলের জন্য নানান খাবার আর গাছপাকা ফল নিয়ে আসে। শফিকুলের খাবার-দাবারের দীন-হীন অবস্থা দেখে চোখের জল ভাসায়। বিয়ে করানোর জন্য গাই-গুই করে। আবার ফিরে যায়। আবার আসে। মা ভেবে পায় না, কেন বিয়ে করে সংসারী হতে চায় না শফিকুল। ছেলেকে ঠিকঠাক বুঝতে পারে না দেখে, আগের যুগের মানুষ ভেবে নিজেকে শাপ-সাপান্ত করে।

এখনো দুপুরে খাওয়া হয় নি শফিকুলের। তাঁর জন্য টেবিলে ভাত-তরকারি সাঁজিয়ে কেউ পথ চেয়ে বসে থাকবে না। বাসায় দ্রূত ফেরার তাগাদা নেই। তবুও হাস-ফাঁস করতে থাকে শফিকুল। রাজ্যের বিরক্তি নিয়ে জানালার গ্রিল ধরে দাঁড়ায়। হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ফোঁটা ছোঁয়ার চেষ্টা করে। আরো বেশি বিষন্ন হয়ে ওঠে শফিকুলের মন। চেনা চারিপাশ একটা অচেনা আলোয় যেন আচ্ছন্ন হয়ে আছে। কে যেন কাঁদে। কে কাঁদে? অনেক চেনা কেউ কি? অস্ফুটস্বরে রূপার নাম উচ্চারন করে শফিকুল। কেমন আছে সে? ঘরটার মঝে রূপার অশরীরি উপস্থিতি টের পায় শফিকুল। সেই পরিচিত পারফিউমের গন্ধ! রিনিঝিনি কাঁচভাঙা হাসি! জানালার গ্রিন গলে সামনের দিকে তাঁকায় শফিকুল। বুকের গহীন থেকে একটা জমানো দীর্ঘ শ্বাস বের হয়ে আসে। ভালোবাসায় তো এতটুকু খাঁদ ছিল না তাঁর। শুধু ছিল সময়ের কাছে সেদিনের অসহায় আত্ন-সমর্পন।

রূপার বিয়ে হয়ে যাবার মাসখানেক পরেই বিসিএসের রেজাল্ট বের হল। এরপর এসিল্যান্ড হিসেবে নিভৃত এই মফশ্বল শহরে শফিকুলের আত্ন-নির্বাসন। দেখতে দেখতে তিনটি বছর চলে গেল। কেমন আছে রূপা? অস্ফুটস্বরে নামটি উচ্চারন করে শফিকুল। এতদিন তাঁকে ভুলেই তো ছিল। তবে কি ভালোবাসা মিথ্যে ছিল? ওতে কোনো খাঁদ ছিল?

পুকুরের এক কোণে সাদা শাপলার মেলা বসেছে। বৃষ্টির জলের কোমল ছোঁয়া সাদা শাপলার হাসিকে যেন আরো মোহনীয় করে তুলেছে। কার হাসি সুন্দর, ঐ সাদা শাপলার নাকি রূপার? শফিকুল মনে মনে তুলনার অঙ্ক কষে। নাহ! তুলনাটা করা হয়ে ওঠে না। কিছুতেই রূপার ছবিখানা মনে করতে পারে না শফিকুল। একখানা হাসি-হাসি মুখ, বড় মনোহর একজোড়া চোখ, পাতলা ঠোট, চিকন বাঁশির মত নাক; নাহ! মনে পড়ে না। তবে কি ভালোবাসা মিথ্যে ছিল, নাকি মরে গেছে? কে যেন কাঁদে। অনেক চেনা কেউ। কে কাঁদে? শফিকুলের রূপা? নাকি সে শুধুই মৃত ভালোবাসা। হারিয়ে যাওয়া রঙিন স্বপ্ন। হারিয়ে যাওয়া সোনালী দিনগুলি।

একটা চিনচিনে ব্যাথায় ককিয়ে ওঠে শফিকুলের বুক। চারিদিকের চেনা পৃথিবীটা বড় অচেনা মনে হয়। ব্যাথায় বুকটা ক্রমশ ভারি হয়ে ওঠে। বুক ভরে শ্বাস নিতে ইচ্ছে করে শফিকুলের। বৃষ্টিতে ভিজতে খুব ইচ্ছে করে। বৃষ্টির জলে ধুয়ে ফেলতে ইচ্ছে করে বুকের মাঝে জমাট বাধা পুরোনো ধুলো পড়া প্রেম আর চাপা পড়া দীর্ঘ শ্বাস। বৃত্তবন্দী জীবনটা ভেঙে ইচ্ছে করে বহু দূরে যেতে। বহূ দূরে। একাকী হাঁটতে ইচ্ছে করে সমুদ্র সৈকতে। ইচ্ছে করে সমুদ্রের বিশাল বিশাল ডেউয়ের বালিয়ারীতে আছড়ে পরা দেখতে। ইচ্ছে করে পাহাড়ের চূড়ায় উঠে বসে থাকতে সারাটা দিন। চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করে, রূপা মরে গেছে। যে শফিকুল রূপাকে ভালোবাসত, সেও মরে গেছে। আছে শুধু মুক্তি, আছে আনন্দ। নিজেকে ফিরে পাবার আনন্দ। বৃত্তবন্দী জীবনটা ভেঙে ফেলার আনন্দ।

7 comments on “শ্রাবণের দ্বিতীয় দিবস

  1. আশাবাদী
    অক্টোবর 29, 2010

    নাহ এই লেখাটা তেমন ভালো হয়নি 😦

    প্রাক্তন প্রেম সবসময়ই কষ্টের কিন্তু তাই বলে নিজের জীবনকে ধ্বংস করতে থাকাটা ঠিক নয়।

    Like

    • শেখ আমিনুল ইসলাম
      অক্টোবর 29, 2010

      অশেষ কৃতজ্ঞতা আশাবাদী ভাই। আপনার মন্তব্যে আমি সব সময় অনুপ্রেরণা পাই। এই গল্পটা একটা এক্সপেরিয়েন্স পাওয়ার উদ্দ্যেশে লিখেছি, কারন এর আগে কখনো ‘আমি তুমি’ টাইপের প্রেমের গল্প লিখিনি। অবশ্য নিজেকে দুঃখবাদী ভাবতে কেমন যেন একটা আনন্দ লাগে 🙂

      Like

  2. রাহাত-ই-আফজা
    নভেম্বর 21, 2010

    গল্পটা মোটামুটি লেগেছে।খুব ভাল না আবার একদম খারাপও না।শফিকুলের চরিত্রটা কেন যেন দূর্বল মনে হয়েছে।জীবনটা অনেক কঠিন,৩বছরে জীবনে এত পরিবর্তন আসে যে প্রাক্তন প্রেম জীবনে চলার পথে এত প্রভাব ফেলতে পারে বলে আমার মনে হয় না।

    Like

    • শেখ আমিনুল ইসলাম
      নভেম্বর 21, 2010

      আমার ব্লগে স্বাগতম জানাচ্ছি। সুন্দর বিশ্লেষণধর্মী মন্তব্যের জন্য অনেক ধন্যবাদ।
      শফিকুল ধাক্কাটা মনে হয় খুব বেশিই পেয়েছিল :)। তাই রেশটাও তিন বছর ধরে চলেছে, রেল গাড়ির মত, থামার পরও আস্তে আস্তে আরো কিছু দূর এগোয়। তারপরে থেমে যায়, আবার নতুন করে চলতে শুরু করে। শফিকুলের মাঝেও বৃত্তটা ভেঙে নতুন করে নিজেকে পাবার একটা আকুলতা শেষে এসে দেখা গেছে।

      অনেক ভালো থাকবেন। শুভেচ্ছা 🙂

      Like

  3. তাপস
    ডিসেম্বর 9, 2010

    আমার কিন্তু ভালই লাগল । ব্যাক্তি ও সময়ভেদে প্রতিক্রীয়া ভিন্ন হয় বই কি । একাকিত্ব হয়ত তোমার নায়ককে পেছনে টেনে নিয়ে গেছে বেশী করে ।

    Like

    • শেখ আমিনুল ইসলাম
      ডিসেম্বর 9, 2010

      সহমত তাপসদা, ব্যাক্তি ও সময়ভেদে ভালো লাগা ভিন্ন হবেই।
      অনেক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। শুভেচ্ছা 🙂

      Like

  4. আল-আমিন
    এপ্রিল 24, 2015

    নিজেকে ফিরে পাবার আনন্দ। বৃত্তবন্দী
    জীবনটা ভেঙে ফেলার আনন্দ।
    বৃত্ত ভাঙার প্রবল ইচ্ছা বেশ ভাল লেগেছে।

    Like

আপনার মন্তব্য লিখুন

Information

This entry was posted on অক্টোবর 28, 2010 by in গল্প and tagged .

নেভিগেশন