আম আঁটির ভেঁপু

নিন্দুকেরে বাসি আমি সবার চেয়ে ভালো…

মুভি রিভিউ : 8½ (1963)

8½হাতের মুঠোয় এক খণ্ড অবসর পেলে, মাঝে মাঝে ভাবি কিছু একটা লিখি। সাদা কাগজে কালো বলপয়েন্ট কলমের আঁচড় কাটি। কত প্লট, পটভূমি, বাক্য, ছন্দ মাথার ভিতরে ঘুরঘুর করে, পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা আঁকিবুকি, ছিড়ে ফেলা। না হয় কবিতা, না হয় গল্প। বেলকোনির এপাশ থেকে ওপাশে অস্থির অসহায় পায়চারি, অথবা দূরের সবুজ পাহাড়ের গায়ে সাদা মেঘের বিষণ্ণ উড়ে যাওয়া দেখা।

‘Writer’s block’ নামে একটা শব্দ জানা ছিল। ফে্ডরিকো ফেলিনির 8½ (1963) মুভিটি দেখে ‘Director’s block’ সম্পর্কে জানা হল। একটা ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন দিয়ে মুভিটি শুরু। অসহনীয় ট্রাফিক জ্যাম। সামনে পিছনে, ডানে বায়ে চারিদিকে গাড়ি। ড্রাইভার একাকি আটকে পড়েছে তাঁর গাড়িতে। গাড়ির দরজা, জানালার কাচ লক্ড হয়ে আছে, বেরুবার উপায় নেই। অন্য গাড়িগুলোর ড্রাইভার, যাত্রী তাঁর দিকে ভাবলেশহীন তাকিয়ে আছে। গাড়ির ইঞ্জিন থেকে সাদা ধোয়া বের হতে শুরু করলে সে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। বের হবার জন্য অনবরত জানালার কাচে আঘাত করতে থাকে। একপর্যায়ে জানালার কাচ গলিয়ে বাইরে এসে, সাদা ধোয়ায় আচ্ছন্ন দম বন্ধ অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়ে সে দুহাত প্রসারিত করে উড়তে থাকে। অন্য গাড়িগুলোর উপর দিয়ে উড়ে উড়ে সে মুক্ত পৃথিবীর স্নিগ্ধ শান্ত সাগর সৈকতে চলে এলে, কেউ একজন তাঁর পায়ে দড়ি বেঁধে টেনে নিচে নামিয়ে আনে। গাড়ির ড্রাইভার বিখ্যাত ইতালিয়ান চলচ্চিত্র পরিচালক গুইদো আনসেল্মি (Marcello Mastroianni), যিনি স্বপ্নটার মত বাস্তবেও ‘Director’s block’ এ ভুগছেন। একটি সাইন্স ফিকশন মুভি বানানোর জন্য সেট তৈরী করলেও, সুনির্দিষ্ট গল্পের অভাবে সামনে এগোতে পারছেন না। কখনো মনে হচ্ছে তাঁর শৈশবের ফ্যান্টাসী আর স্মৃতি নিয়ে এগোবেন, আবার কখনো মনে হচ্ছে নিজের জীবনবোধ, স্ত্রীর সাথে ব্যক্তিগত জীবনের টানাপোড়েন, চার্চ ধর্ম প্রভৃতির মিশেলে মুভিটি দাঁড় করাবেন।

মুভিটির গল্প সরলরৈখিক। প্রথম দৃশ্যেই যেন মুভিটা থেমে আছে, কিন্তু আশ্চর্যরকম জীবন্ত। গুইদো চরিত্রে Marcello Mastroianni মন্ত্রমুগ্ধের মত অভিনয় করে গেছেন। ফেডরিকো ফেলিনির শেষ সাদা কালো ইতালিয়ান এই মুভিটি কমেডি ধাঁচের। La Dolce Vita (1960) এর পর পূর্ণদৈর্ঘ্য আরেকটি মুভি বানাতে ফেলিনি সময় নিয়েছেন তিন বছর। অনেকেই বলেন এটি ফেলেনির অটোবায়োগ্রাফিক মুভি। গুইদো চরিত্রটি আর কেউ নয়, ফেলিনি নিজেই। গুইদোকে দিয়ে নিজেকে ভেঙেছেন, জয় করেছেন, আমিত্বের স্বরূপ জেনেছেন। গুইদোকে দিয়ে বলিয়েছেন, “আমি যেমন আছি, সেভাবেই আমাকে গ্রহণ কর। কেবল তখনই আমরা একে অপরকে আবিষ্কার করতে পারব”, “আমার জীবনের যত দ্বিধা, সে আমার আমিত্বেরই প্রতিবিম্ব! আমি যা তাই, যা হতে চাই তা নই”।

8½ (1963) এর আগে তিনি ছয়টি পূর্ণদৈর্ঘ্য মুভি, দুটি শর্ট ফিল্ম (১/২), আর পরিচালক আলবার্তো লাতুয়াদার সাথে যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন প্রথম মুভি Variety Lights (1950) (১/২)। তাই ফেলিনি এ মুভিটির নাম দেন 8½ (ইতালিয়ান টাইটেল- Otto e mezzo, ইংরেজি- Eight and a Half)।

১৯৬৪ সালে বিদেশি ভাষায় অস্কার জিতে নেয়া এই ইতালিয়ান মুভিটি ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের সর্বকালের সেরা ৫০ মুভির তালিকায় সেরা দশে ঠাঁই করে নিয়েছে। সেই সাথে স্বীকৃতি পেয়েছে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী ক্ল্যাসিক মুভি হিসেবে। মুভিটির IMDB Rating 8.2/10, আর রোটেন টম্যাটোতে এটি পেয়েছে ৯৮% ফ্রেস মুভির স্বীকৃতি। যারা নিয়মিত সিনেমা দেখেন, সিনেমা নিয়ে ভাবেন, পড়াশুনা করেন, সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখেন, তাঁদের জন্য নিঃসন্দেহে মাস্ট সী সিনেমা এটা।

সূত্র:
১। উইকিপিডিয়া ডট ওআরজি
২। আইএমডিবি ডট কম
৩। রোটেনটম্যাটোস ডট কম

আপনার মন্তব্য লিখুন

নেভিগেশন